সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। এক মোটরসাইকেলে চলেছেন চারজন আরোহী। তিন জনেরই নেই হেলমেট। বসার জায়গা না থাকায় একজন দাঁড়িয়েছেন পাদানির ওপর। পেছন থেকে হেডলাইট জ্বেলে ধেয়ে আসছে একটি বাস। একটু অসাবধানতায় ঘটতে পারে বড় কোনো দুর্ঘটনা। নাটোর-কুষ্টিয়া মহাসড়কের ঈশ্বরদীর রূপপুর এলাকায় তোলা ছবিটি ‘ঝুঁকি’ শিরোনামে গত ৬ মে তারিখে ছাপা হয়েছিল প্রথমআলো’র ৩ পাতায়। মোটরসাইকেলের পেছনে দাড়ানো সুজন মন্ডলের পরিবারের কাছে এই ছবিটি এখন শুধুই স্মৃতি। বেদনাদায়ক এক গল্পের নিদর্শনও বটে।
“আমি চেষ্টা করেছিলাম হেলমেট পরাতে। শুধু পুলিশ ধরে-বেধে আইন মানাতে পারবে না। পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সমাজের সকল স্তরে হেলমেটের ব্যবহার ও সড়ক আইন মেনে চলার চর্চা করতে হবে। তাই আইন প্রয়োগের পাশাপাশি সচেতনতা সৃষ্টিও সমান জরুরী ”- ছবিটি দেখে এমন মন্তব্য করেছিলেন পাবনার সাবেক পুলিশ সুপার মহিবুল ইসলাম খান। মোটরবাইকের দুর্ঘটনা ও প্রানহানী রোধে বেশ কঠোর ভুমিকা ছিল তার। এছাড়াও কিছু উদ্যোগ ও ভালো কাজের জন্য তিনি পাবনাবাসীর কাছে সুপারম্যান হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন। বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালকদের কথা উঠতে এখনো উঠে আসে তার কথা। তাই তার কথার সুর ধরেই তাই বলতে হয়, সচেতনতার বার্তা ছড়িয়ে দিতে সমাজের অনেক পেশার মানুষ কাজ করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত । কিন্তু আদৌ কি ফিরছে সচেতনতা ?
এবার তবে মুল ঘটনায় আসি। আজ ৩১ মে, বুধবার সকাল সাড়ে এগারোটায় মোটরবাইক নিয়ে আত্মিয়ের বাড়িতে যাবার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলেন সুজন মন্ডল। মাঝ পথে স্যালো ইঞ্জিনচালিত ট্রলির (স্থানীয় নাম কুত্তাগাড়ি) সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষ হলে ঘটনাস্থলেই নিহত হন তিনি। পাবনার আটঘরিয়া উপজেলার মাঝপাড়া ইউনিয়নের দুর্গাপুর মজিবর মোড় এলাকায় এই দুর্ঘটনা ঘটে। ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা হয় দুর্ঘটনায় ভাঙ্গাচুরা মোটরসাইকেল ও আটক করা হয় ট্রলি গাড়িটি।
পুলিশ ও স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, পাবনার আটঘরিয়া উপজেলার মাঝপাড়া ইউনিয়নের দরবেশপুর গ্রামের ফরহাদ মন্ডলের ছেলে সুজন মন্ডল পেশায় একজন টিন মিস্ত্রী ছিলেন। ভালো কাজের জন্য মাঝপাড়া এবং মুলাডুলি ইউনিয়নের মানুষের কাছে তার বেশ সুনাম ও পরিচিতি রয়েছে। তিনি বিভিন্ন বাড়ি-ঘর ও দোকানের টিনের কাজ করতেন। কাজের পাশাপাশি তিনি ঘুরতেও ভালোবাসতেন। নিজের কোনো মোটরসাইকেল না থাকায় অন্যের মোটরসাইকেল ধার করে ঘুরতেন তিনি। তবে হেলমেট ব্যবহারে অনেকের মত তারও উদাসীনতা ছিল। আজকের দুর্ঘটনার মোটর সাইকেলটিও ছিল ধার করা। যথারীতি মাথায় ছিল না কোনো হেলমেট। দুর্ঘটনায় সংঘর্ষের সময় ট্রলি গাড়িটির হেডলাইটের পাতে লেগে তার মাথা গুরুতর জখম হওয়ায় তাকে আর বাঁচানো সম্ভব হয়নি। সেখানে তার মাথার চুল ও রক্তের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মত।
তার প্রতিবেশি জাহাঙ্গীর আলম জাহিদ পড়েন পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের ইংরেজি বিভাগে। তিনি দীর্ঘ ১০ বছরের উপরে প্রথমআলোর পাঠক। তাই ছবিটি তার দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি। তার সাথে কথা হলে তিনি জানান, ছবিটি যখন প্রথমআলোতে ছাপা হয়েছিল তখন সুজন মামাকে দেখেই চিনতে পারি। সেদিনই পত্রিকাটা তাকে দেখিয়ে সচেতন হবার কথা বলেছিলাম। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, ছবি ছাপা হবার এক মাস যেতে না যেতে সেই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনাতেই মামা মারা গেলেন। আজ যদি তার হেলমেটাও পরা থাকতো তবুও হয়তো এ যাত্রায় বেঁচে যেতেন তিনি।
ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে আটঘরিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন বলেন, হেলমেট না থাকায় মাথায় গুরুতর আঘাত পেয়ে সুজন মন্ডলের মৃত্যু হয়। পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো অভিযোগ না থাকায় বিনা ময়নাতদন্তে আমরা লাশ তাদের কাছে বুঝিয়ে দিয়েছি।
সুজন মন্ডলের মত অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুগুলো আমাদের মনভারী করে দেয়। সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে প্রয়োজন একটু সচেতনতা, ধৈর্য, সতর্কতা আর ট্রাফিক আইনের যথাযথ প্রয়োগ। আমাদের দেশে যেহেতু একই রাস্তায় বৈধ-অবৈধ সকল ধরনের যানবাহান চলে তাই বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানোর প্রবণতা কমানো খুবই জরুরী। ট্রাফিক আইনের যদি যথাযথভাবে প্রয়োগ করা হয় এবং আইন লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে যদি কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় তাহলে সড়ক দুর্ঘটনার পরিমাণ অনেক কমে যাবে। সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাস করার জন্য গাড়ির লাইসেন্স ও চালকদের লাইসেন্স প্রদানের জালিয়াতি প্রতিরোধ করতে হবে। লাইসেন্সবিহীন, ফিটনেস বিহীন অবৈধ যানবাহন চলাচল বন্ধ করতে হবে।
সুজন মন্ডলের মত দুর্ঘটনায় মৃত্যুতে পরিবারের স্বজনদের স্বপ্ন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। সারা জীবনের কান্না হয়ে তা বয়ে বেড়াতে হয়। কিন্তু তবুও মানুষকে পথ চলতে হয়। মানুষের পথ চলা যতদিন থাকবে দুর্ঘটনাও হয়তো ততদিন থাকবে। তাই সচেতন হতে হবে চালক, যাত্রী, পথচারী, ট্রাফিক পুলিশ সবাইকে। সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধের কার্যক্রম জোরদার করতে এগিয়ে আসতে হবে সবাই মিলে। তবেই এ নিঃশব্দ ঘাতকের রোধ করা সম্ভব। সর্বশেষ একটিই কথা, বাড়াতে হবে জনসচেতনতা। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে যার বিকল্প কোন শব্দ হয়তো আপাতত আমাদের দেশে আর দ্বিতীয়টি নেই!
তাই সকলের প্রতি, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের প্রতি আহবান জানিয়ে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সুরে সুুর মিলিয়ে বলতে চাই-
“আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে?
তোমার ছেলে উঠলে গো মা রাত পোহাবে তবে!’
হাসান মাহমুদ, চিত্র সাংবাদিক, প্রথমআলো