পাবনা সদরের দুবলিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের সঙ্গে প্রধান শিক্ষক আনোয়ার হোসেনের দ্বন্দ্বে পড়াশোনার বেহালদশায় পরিনত হয়েছে। ভেঙে পড়েছে স্কুলটির অবকাঠামো। ৬ষ্ঠ শ্রেণি থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত ৪ টি সাবজেক্টের কোন একটি সাবজেক্টের ক্লাস হয়নি। পড়াশোনা না করায়ে অতিরিক্ত বেতন আদায় করছে প্রতিষ্ঠানটি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বুধবার (০৩ জুলাই) থেকে উচ্চ বিদ্যালয়ের ষান্মাসিক পরীক্ষা শুরু হয়েছে। পরীক্ষা শুরু সকাল ১০ টা থেকে হওয়ার কথা থাকলেও পরীক্ষা শুরু হয় সকাল সাড়ে ১০ টার পর থেকে। শিক্ষার্থীদের থেকে বেতন না দেওয়া পর্যন্ত পরীক্ষার হলে ডুকতে দেওয়া হয়নি। পরে স্থানীয় সাংবাদিকরা বিষয়টি জানতে পেরে বিদ্যালয়ে গেলে প্রধান শিক্ষক তরিঘরি করে খাতা দিয়ে পরীক্ষার হলে শিক্ষার্থীদের বসানো হয়। ৬ ষ্ঠ শ্রেণি থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত ১ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ১৪০০ পর্যন্ত টাকা আদায় করা হচ্ছে।
অথচ ৬ষ্ঠ শ্রেণি থেকে নবম শ্রেণির ৪ সাবজেক্টের কোন ক্লাসই হয়নি। প্রথম ক্লাসে শুধু নাম হাজিরা আর বেতন আদায়ের রশিদ কেটেই শেষ হয়। ক্লাস রুটিন হওয়ার কথা জানুয়ারিতে সেই ক্লাস রুটিন হয়েছে জুন মাসের শেষের দিকে। পরীক্ষার দিন ও আগেরদিন বেতন আদায় করছে শিক্ষকরা। প্রতি মাসে স্কুলের দপ্তরী দিয়ে বেতন আদায়ের নিয়ম থাকলেও নিয়মবহির্ভূতভাবে ছয় মাসের বেতন একসঙ্গে আদায় করছে শিক্ষকরা। এতে দিশেহারা হয়ে পড়েছে অভিভাবকরা।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের স্বেচ্ছাচারিতায় স্কুলের অবকাঠামো ভেঙে গেছে। গত এসএসসি পরীক্ষায় ২ শতাধিক শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করে। এদের মধ্যে ৭৫ জন অকৃতকার্য হয়। শিক্ষকরা ছাত্রদের পড়াশোনা করানো বাদ দিয়ে টাকা উত্তোলনে ব্যস্ত থাকেন। সেই টাকার কোন হিসেবও থাকে না। যারযার ইচ্ছেমত টাকা উঠিয়ে পকেট ভর্তি করে। ক্লাস রুমে প্রাইভেট পড়ানোর কোন বৈধতা না থাকলেও কয়েকটি শিক্ষক ভোর থেকে সকাল ১০ টা পর্যন্ত প্রাইভেট পড়ানোয় ব্যস্ত থাকে। ছাত্ররা ক্লাসে ডুকতে না পেরে অনেকে বাড়িতে ফিরে যায়। আবার অনেকে ক্লাসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, স্যাররা ঠিকমত ক্লাস না করিয়ে দলাদলিতে ব্যস্ত থাকেন। দুপুর ১ টার পরে আর কোন ক্লাসই হয়না। যার জন্য প্রতিটি ক্লাসের ৪ টি সাবজেক্টের কোন ক্লাস নেওয়া হয়নি। আমরা এজন্য ১ টার আগেই বাড়িতে চলে যাই। প্রথম ক্লাসে পড়ানো বাদ দিয়ে শুধু হাজিরা করে আর বেতন তোলে। প্রতি মাসে বেতন নেওয়ার কথা থাকলেও ৬ মামের বেতন একসঙ্গে নিচ্ছে। তাও অতিরিক্ত টকা নেওয়া হচ্ছে। ক্লাসই ঠিকমত করায় না তাহলে আমরা বেতন দিব কেন?। স্যাররা আমাদের ভবিষ্যত নষ্ট করে দিচ্ছে।
অভিভাবকরা অভিযোগ করে বলেন, এই স্কুলে সন্তানদের ভর্তি করে ব্যাপক মাশুল দিতে হচ্ছে। আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যত নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ঠিকমত পড়াশোনা হয়না। ক্লাস রুম অপরিচ্ছন্ন থাকে। ক্লাসের ফ্যান নষ্ট। ১০ টার দিকে বাড়ি থেকে স্কুলে এসে ১২ টার মধ্যেই আবার বাড়িতে ফিরে যান। আমরা জিজ্ঞাসা করলে সন্তানরা উত্তর দেয় স্যাররা পড়ায় না তাই বাড়িতে চলে আসছি। ঐতিহ্যবাহী একটি স্কুল আমাদের চোখের সামনে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এসএসসি পরীক্ষায় ৭৫ জন ফেল করে এটা আমাদের জন্য লজ্জাকর ব্যাপার। প্রতি মাসে বেতন না দিয়ে একসঙ্গে অতিরিক্ত টাকা দেওয়া আমাদের জন্য কষ্টকর। আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে এখানে পড়াশোনার সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরে আসুক এই দাবি করেন।
নাম প্রকাশে কয়েকজন শিক্ষক জানান, এই স্কুলের শিক্ষকরা অতিমাত্রায় প্রাইভেট বাণিজ্যে জড়িত থাকায় তারা শ্রেণিতে পাঠদানে আন্তরিক নন। প্রাইভেট পড়ানোর কোন বৈধতা না থাকলেও প্রধান শিক্ষকের প্রশ্রয়ে এসব নিয়মিত করছে কিছু অসাধু শিক্ষকরা। গনিতের সিনিয়র সহকারী শিক্ষক, বাবুল কর্মকার, সামাজিক বিজ্ঞানের সহকারী শিক্ষক কামাল হোসেন, ইংরেজির সহকারী শিক্ষক খায়রুল ইসলাম, সামাজিক বিজ্ঞানের সহকারী শিক্ষক হাবিবুর রহমান ডাবলুসহ প্রাইভেট পড়াতে ব্যস্ত থাকা শিক্ষকদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করার আহবান জানান।
শিক্ষকরা আরও বলেন, প্রধান শিক্ষক ইচ্চেমত স্কুল পরিচালনা করছেন। টাকা পয়সা তুলে নিজেই আত্মসাত করছে। শিক্ষকরা কিছু বললে তাদের নানাভাবে হয়রানি করা হয়। বিদ্যালয়ের জায়গায় গোয়ালঘর নির্মাণের খবর মিডিয়াতে প্রকাশ হলে সেটি ভেঙে দেওয়া হয়। এখন বিদ্যালয়ের জায়গা এনজিওদের কাছে ভাড়া দিয়েছে।
এ বিষয়ে দুবলিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আনোয়ার হোসেন বলেন, স্কুলে ঠিকমত ক্লাস হয়না এটা মিথ্যা কথা। তবে দুর্নীতির বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি সদুত্তর দিতে পারেননি।
পাবনা জেলা শিক্ষা অফিসার রোস্তম আলী হেলালী বলেন, এর আগেও দুবলিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে সমস্যা হয়েছিল। আমরা খবর পেয়ে কয়েকদফা সেখানে গিয়েছিলাম। আসলে ওই স্কুলের বিষয়ে সুরাহা হওয়া দরকার। প্রধান শিক্ষক আনোয়ার হোসেনের উচিত সকল শিক্ষকদের নিয়ে সুন্দরভাবে স্কুল পরিচালনা করা। আজকে প্রথম স্কুল শুরু হয়েছে। আমরা ডিউটিতে আছি। ওই স্কুলে গিয়ে বিষয়টি দেখা হবে।
উল্লেখ্য : ২০০৭ সালে জুনিয়র শিক্ষক আনোয়ার হোসেন দলীয় প্রভাব খাঁটিয়ে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক শওকত আলীকে কিডন্যাপ করে মেরে ভয় দেখিয়ে তিনি ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হন। ৭ বছর ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক থাকা অবস্থায় তিনি বিএড সার্টিফিকেট ক্রয় করেন এবং কম্পিউটার শিক্ষক থেকে জৈষ্ঠতা লংঘন করে প্রধান শিক্ষকের নিয়োগ নেন। প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগ নিয়ে পূর্বের সহকারি শিক্ষক পদের ৩-৪ বছরের বেতন গ্রহণ করেন। তার বিএড সার্টিফিকেটও অবৈধ। ২০১৯, ২০২০, ২০২১ সালের বিদ্যালয়ের প্রায় ৫০ লক্ষ টাকার কোনও হদিস নেই। স্কুলের জায়গায় নিজের গোয়াল ঘর তৈরি করে গরুর ব্যবসা করতেন-যা ইতোমধ্যে গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। বিদ্যালয়ের মার্কেট তৈরিতে বিভিন্ন দ্রব্য ক্রয়, রড সিমেন্ট, বালি নিজে সরবরাহ করেন এবং সেখান থেকে প্রায় ১ কোটি টাকা এবং মার্কেটের রুম অবিকৃত দেখে নিজে ব্যবহার ও ভাড়া খাটিয়ে প্রায় ১০ লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এছাড়াও মার্কেটের রুম বিক্রি, পুকুর ভরাট, শতবর্ষীয় মেলার লক্ষ লক্ষ টাকা, স্কুলের রাস্তার নামে, করোনাকালীন সময়ে শিক্ষার্থীদের ৫০ লাখ টাকা, গেট তৈরির ২০ লক্ষ টাকা, ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে আদায়কৃত লক্ষ লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এমনকি স্কুলের ভবন নির্মাণের বেচে থাকা ১৫ থেকে ২০ হাজার ইট নিয়ে নিজের বাড়ি তৈরিতে ব্যবহার করেছেন। বিদ্যালয়ের মার্কেটে নিজের নামে ইসলামী ব্যাংকের এজেন্ট ব্যাংক শাখা পরিচালনা করে আসছেন। ১৬-১৭-১৮ অর্থ বছরের শিক্ষক-কর্মচারীদের বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা ভাতা দেয়ার কথা বলে বেতন লেজারে সই করিয়ে নিলেও তাদেও কোন টাকা পয়সা না দিয়ে জোরপূর্বক সাক্ষর করে নেন। ’ এরপর দুর্নীতির খবর বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশ হলে প্রধান শিক্ষকের বেতন-ভাতা বন্ধ করে দেওয়া হয়।