ঘটনাটি ২০১৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর, মঙ্গলবার পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার পাকশী নর্থবেঙ্গল পেপার মিলস হাই স্কুলে। সেদিন সকালে বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণীর ছাত্র তাফসির একটি প্লাস্টিকের খেলনা সাপ দিয়ে ভয় দেখান স্কুলের শিক্ষিকা খাদিজা পারভিনকে। শিক্ষিকা ভয় ও লজ্জা পেয়ে বিষয়টি শিক্ষকদের জানান। শিক্ষিকার অভিযোগে বিদ্যালয়ের তৎকালীন সহকারী প্রধান শিক্ষক নিত্যনন্দন সুত্রধর ক্লাশে গিয়ে ছাত্র তাফসিরকে শাসিয়ে সাপটি কেড়ে নিয়ে আসেন। ঘটনার পর ঈশ্বরদীর আলোচিত মামলার ভিক্টিম তার ভাই ছাত্রলীগ কর্মীকে বিষয়টি জানায়।
তার ভাই তখন বন্ধুকে সঙ্গে করে বিদ্যালয়ে এসে ক্লাশ চলাকালে ক্লাসে প্রবেশ করে সহকারী প্রধান শিক্ষকের পেটে চাকু মারার চেষ্টা করে। কিন্তু তার একটি হাত না থাকায় সে ব্যর্থ হয়। এরপর তারা শিক্ষককে বেদম মারপিট করে।
এই ছাত্রলীগ কর্মীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে পরদিন ১৬ সেপ্টেম্বর, বুধবার বিষয়টি থানায় লিখিত অভিযোগ, ক্লাস বর্জন ও মানববন্ধন করেছিলেন বিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষিকা ও ছাত্র-ছাত্রীবৃন্দ।
সেই ৮ম শ্রেনীর ছাত্রের নাম তাফসির আহমেদ মনা, তার ভায়ের নাম হাতকাটা টুনটুনি ও ভাইয়ের বন্ধুর নাম মুন্না।
তৎকালীন ছাত্রলীগ পাকশী শাখার সাধারণ সম্পাদক মিরাজ হাসান জানিয়েছিলেন, টুনটুনি ও মুন্না ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী। এর আগে একই কমিটির সভাপতি সদরুল হক পিন্টুর সঙ্গে গ্রুপিংয়ের কারণে পিন্টু গ্রুপ টুনটুনির বামহাত কেটে ফেলে। এই মামলায় প্রধান আসামি হিসেবে বর্তমানে সভাপতি পিন্টু জেল হাজতে রয়েছে। তবে টুনটুনির এই ধরনের কাজের তিনি নিন্দা জানান।
মানববন্ধনে বিদ্যালয়ের প্রধানশিক্ষক ফজলুল হক, পাকশী পেপার মিলস স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ব্যবস্থাপক এ কে এম মহিউদ্দিন, বীরমুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ রশিদুল্লাহ, মহিলা অভিভাবক প্রতিনিধি আইরিন খান, সিকিউর্রিটি ইনচার্জ দাউদ খানসহ এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ দোষীদের গ্রেফতার দাবি করে বক্তব্য রেখেছিলেন।
ঈশ্বরদী থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বিমান কুমার দাশ জানিয়েছিলেন, আমরা থানায় প্রধানশিক্ষক স্বাক্ষরিত একটি অভিযোগ পেয়েছি। অভিযোগটি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে দোষীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এই ঘটনাটি প্রথম ঘটনার কিছুদিন আগে। ২০১৫ সালের ১ জুন, সোমবার বিকেলে ঈশ্বরদীর পাকশী রূপপুর মোড় এলাকায়। দলীয় অভ্যন্তরীণ বিরোধের জের ধরে সৌরভ হোসেন টুনটুনি নামে ছাত্রলীগের এক কর্মীর বাম হাত কেটে নেয় প্রতিপক্ষ গ্রুপ।
টুনটুনি তখন পাকশী পেপার মিলস উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, রোববার রূপপুর মোড়ে মিজান নামে ছাত্রলীগের এক কর্মীকে টুনটুনি মারধর করে। ওই ঘটনার জের ধরে সোমবার বিকেলে টুনটুনিকে বাড়ি থেকে ডেকে পাকশী পেপার মিলের সামনে নিয়ে আসে প্রতিপক্ষ গ্রুপ। এ সময় তারা রামদাসহ ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে তাকে জখম করে বাম হাত কাঁধের নিচ থেকে কেটে আলাদা করে ফেলে। পরে খণ্ডিত হাত নিয়ে তারা কয়েকটি মোটরসাইকেলে করে মহড়া দিয়ে উল্লাস করে রূপপুর মোড়ে কাটা হাতটি ফেলে যায়। পরে মুমূর্ষু অবস্থায় টুনটুনিকে উদ্ধার করে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
এ বিষয়ে পাকশী ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি পিন্টু জানিয়েছিলেন, এটা ছাত্রলীগের কোনো বিষয় নয়। টুনটুনি উচ্ছৃঙ্খল যুবক, সে ছাত্রলীগের কেউ নয়। ঘটনাটি পেট্রোল পাম্পের যাত্রী ওঠানো-নামানোর আধিপত্য নিয়ে ঘটেছে।
তবে ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মিরাজ হাসান দাবি করেছিলেন, আহত টুনটুনি ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী। সভাপতি গ্রুপের কর্মীরা তার হাত কেটে নিয়েছে।
ঈশ্বরদী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বিমান কুমার দাশ এ তথ্য নিশ্চিত বলেছিলেন, ছাত্রলীগ পাকশী ইউনয়ন শাখার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের গ্রুপিংয়ের কারণে এ ঘটনা ঘটেছে। ঘটনাস্থলে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। এ ঘটনায় মামলার প্রস্তুতি চলছে বলেও তিনি জানান।
এই ঘটনাটি ২০২৩ সালের ১৭ জুন, শনিবার রাত সাড়ে দশটার দিকে। পাবনার ঈশ্বরদীতে দুর্বৃত্তদের গুলিতে তাফসির আহমেদ মনা (২৪) নামের এক যুবক নিহত হন। উপজেলার লক্ষ্মীকুণ্ডা ইউনিয়নের মন্ত্রীর মোড় এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। নিহত তাফসির উপজেলার পাকশী ইউনিয়নের দিয়াড় বাঘইল গ্রামের সৌরভ হোসেন ওরফে হাতকাটা টুনটুনির ছোট ভাই।
স্থানীয় লোকজন ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, গতকাল রাত সাড়ে ১০টার দিকে তাফসির মন্ত্রীর মোড়ে একটি দোকানে বসে ছিলেন। এ সময় মুখে কাপড় বাঁধা তিন থেকে চারজন অস্ত্রধারী তাঁকে ঘিরে ধরে এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে পালিয়ে যায়। এতে তাফসির রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। স্থানীয় লোকজন তাঁকে উদ্ধার করে পাবনা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকেরা মৃত ঘোষণা করেন।
স্থানীয় মানুষের দাবি, পাকশী এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে একটি পক্ষের সঙ্গে তাফসিরের বিরোধ চলছিল। সেই বিরোধের জের ধরে এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।
ঈশ্বরদী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) অরবিন্দ সরকার বলেন, খবর পেয়ে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। সেখান থেকে গুলির খোসাসহ বিভিন্ন আলামত উদ্ধার করা হয়েছে। তাফসিরের লাশ ময়নাতদন্তর জন্য পাবনা জেনারেল হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে। তবে কী কারণে এ হত্যাকাণ্ড, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
গতকাল সোমবার দিবাগত রাত ১২টার দিকে নিহত যুবকের মা নাহিদা আক্তার বাদী হয়ে ১৭ জনকে আসামি করে মামলাটি করেন।
ঈশ্বরদী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) অরবিন্দ সরকার মামলা হওয়ার খবরের সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, রাতে নিহত যুবকের মা থানায় হাজির হয়ে মামলাটি করেন। মামলায় মোট ১৭ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। মামলায় বাদীর দাবি, এলাকায় আধিপত্য বিস্তার ও বালুর ব্যবসা নিয়ে বিরোধে এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। আসামিদের ধরতে অভিযান চালানো হচ্ছে।
ঘটনাটি ২০২৩ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর, সোমবার। বেলা ১১টার দিকে পাবনার পুলিশ সুপার কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে পাবনার পুলিশ সুপার আকবর আলী মুনসী জানান, বালু মহলের নিয়ন্ত্রণসহ আধিপত্য বিস্তার নিয়ে খুন হয়েছিলেন ছাত্রলীগ কর্মী তাফসির আহমেদ মনা (২৪)। চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটনসহ ৯ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এসময় ৩টি আগ্নেয়াস্ত্রসহ অস্ত্র তৈরির বিপুল সরঞ্জামাদি উদ্ধার করা হয়।
নিহত তাফসির আহমেদ মনা ছিলেন উপজেলার পাকশী ইউনিয়নের রুপপুর পাকারাস্তা মোড় এলাকার তাইজুর রহমান তুহিনের ছেলে। তিনি পাকশী ইউনিয়ন শাখা ছাত্রলীগের কর্মী।
এই হত্যা মামলায় গ্রেফতারকৃতরা হলেন- ঈশ্বরদীর নতুন রুপপুরের ইউনুস আলীর ছেলে মানিক (৩৬), সাহাপুর ইউনিয়নের দিয়ার সাহাপুর গ্রামের মুহিদুল হকের ছেলে ফসিউল আলম অনিক (২৭), নতুন রুপপুরের রুপপুর পাড়ার আতিয়ার রহমানের ছেলে চমন (৩৮), চর সাহাপুর গ্রামের আক্তার সরদারের ছেলে শাহিন সরদার(২৮), নতুন রুপপুরের আজিজ প্রামাণিকের ছেলে রাজিব (৩০), চররুপপুর পশ্চিমপাড়ার জহুরুল ইসলামের ছেলে আরিফুল ইসলাম (৩২), সলিমপুরের শাহজাহানের ছেলে আমজাদ হোসেন অবুঝ (৩৭), চররুপপুরের মনিরুল ইসলাম (৩৪), লক্ষীকুন্ডার মাহফুজুর রহমান কালা (৩৫)।
পুলিশ সুপারের দেয়া তথ্য থেকে জানা যায়, নিহত মনা গত ১৭ জুন রাতে লক্ষীকুন্ডা ইউনিয়নের পাকুড়িয়া গ্রামে এমপি মার্কেটে ইকবালের অফিসে আড্ডা দেয়া অবস্থায় রাত ১০টার দিকে ৩ জন অজ্ঞাতনামা সন্ত্রাসী রুপপুর পারমানবিক বিদ্যুত কেন্দ্রের শ্রমিকদের এ্যাপ্রোন ও হেলমেট পড়ে মোটরসাইকেলযোগে এসে মনাকে ৫/৬ রাউন্ড গুলি করে এবং মৃত্যু নিশ্চিত করে দ্রুত পালিয়ে যায়। নৃশংস এই হত্যাকান্ডের পরিপ্রেক্ষিতে নিহত ছাত্রলীগকর্মী মনার মা নাহিদা আক্তার লিপি বাদী হয়ে ঘটনার দুইদিন পর ঈশ্বরদী থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। ঘটনার পর হত্যাকান্ডের অন্যতম মূলহোতা অনিককে গ্রেফতার করে । অনিকের দেওয়া তথ্য ও প্রযুক্তির সহায়তায় ঢাকা, গাজীপুর, কুষ্টিয়া এবং পাবনার বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে কিলিং মিশনে সরাসরি অংশগ্রহণকারী মানিকসহ তাদের অভিযুক্তদের গ্রেফতার করা হয়। অভিযানকালে জিগাতলা এলাকায় অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র তৈরির কারখানার সন্ধানসহ অস্ত্র তৈরির সরঞ্জাম এবং ৩টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়।
আকবর আলী মুনসী আরও জানান, আসামিরদের সাথে মনা পরিবারের দীর্ঘদিনের শত্রুতা, চাঁদাবাজি এবং এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এই হত্যাকান্ড ঘটেছে। এর সঙ্গে বালু মহলের নিয়ন্ত্রণ আছে। বালু মহলও আধিপত্য বিস্তারের অন্যতম কারণ। আসামিদের মধ্যে অবুঝের বিরুদ্ধে পাঁচটি, কালার বিরুদ্ধে ৪টি, মানিকের বিরুদ্ধে ১১টি, চমনের বিরুদ্ধে ১০টি, অনিকের বিরুদ্ধে ৫টি, রাজিবের বিরুদ্ধে ৬টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে।
সময়ের পরিক্রমায় ঘুরে ফিরে আসা এই চারটি ঘটনা শেষে- #মোরাল_অব_দ্যা_স্টোরি কি দাড়ালো তাহলে?
রাজনীতিতে যেমন শেষ বলে কিছু নেই, তেমনি এর সহিংসতারও কোনো শেষ নেই। তার চেয়েও ভয়ঙ্কর যে বিষয় তা হলো প্রকৃতি বলে একটা কিছুর অস্তিত্ব আছে এবং তা ভয়ঙ্কর ভাবেই আছে। সৃষ্টির শুরু থেকেই প্রকৃতি খুব নিষ্ঠুর। আমরা মানুষরা হয়তো সব ভুলে গেলেও প্রকৃতি তা ভোলে না কখনো। ভালো বা মন্দ যাই হোক না কেনো, প্রকৃতি ঠিক তা ফিরিয়ে দেয় এবং সুদে আসলে ফিরিয়ে দেয়। আপনার বা আমার বিশ্বাস হোক আর না হোক এটা শতভাগ সত্যি এবং মানতেই হবে প্রকৃতি কখনো ঋণ রাখেনা।
তবুও আমরা অনেকে তা বুঝি না। বুঝলেও না বোঝার ভান ধরে থাকি অনেকে। সে যাই হোক, দুটি কথা কিন্তু সব সময় মনে রাখতেই হবে-
১. প্রকৃতির প্রতিশোধের কাছে সবাই অসহায়!
২. তাই ক্ষণিকের এই দুনিয়ায়, ভাব নিয়ে লাভ নাই!
#
লেখা ও ছবি: ফটোসাংবাদিক হাসান মাহমুদ ডী এর ফেসবুক থেকে সংগৃহীত।