পাবনার বেড়া উপজেলার স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আলহেরা একাডেমি স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ হাকিমুল কবির ও গভর্নিং বডির বিরুদ্ধে সীমাহীন দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ উঠেছে। পাশাপাশি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা লঙ্ঘন করে প্রথম সাময়িক পরীক্ষা গ্রহণ, প্রাইভেট বানিজ্য, শিক্ষার্থীদের সাথে খারাপ আচরণ, কারণ ছাড়াই শিক্ষকদের বহিস্কারকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের মাঝে উত্তেজনা-বিবাদের সৃষ্টি হয়েছে। এসব বিষয়ে প্রতিকার চেয়ে ঐ বিদ্যালয়ের দুজন সাবেক শিক্ষক শনিবার পাবনা প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেছেন।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, পাবনা বেড়া পৌর এলাকায় ১৯৮৭ সালে স্থাপিত হয় আলহেরা একাডেমি। শুরুতে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের পাঠদান শুরু হলেও ২০০২ সালে প্রতিষ্ঠানটি উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে উন্নীত হয়। শিক্ষার মান ও ঈর্ষণীয় ফলাফলের কারণে প্রতিষ্ঠানটি শুরু থেকে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। এক পর্যায়ে রাজশাহী শিক্ষাবোর্ডর মধ্যে একটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রুপান্তরিত হয়ে ওঠে। পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল বেশির ভাগ বছরগুলোতে পাশের হার ১০০% এবং জিপিএ-৫ পায় ৯০ থেকে ৯৫% শিক্ষার্থী। প্রাথমিক ও জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষাতেও উপজেলার মধ্যে প্রায় ৮০ থেকে ৯০% বৃত্তি প্রতি বছর পেয়ে থাকে। মাধ্যমিক বিদ্যালয় এমপিও ভুক্ত হয় ১৯৯৫ সনে। কলেজ শাখা প্রতিষ্ঠা হয় ২০০২ সনে আর এমপিও ভুক্ত হয় ২০০৪ সনে।
ওই প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন শিক্ষকের দেয়া লিখিত অভিযোগ থেকে জানা যায়, প্রতিষ্ঠানের নামে জমি রেজিস্টেশন না করে ভূয়া ট্রাস্টি বোর্ড ‘আল ইসলাম ট্রাষ্ট’ নামে রেজিস্ট্রেশন করা হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী কোন এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠান করতে পারে না। একাডেমীর ট্রাস্টিবোর্ড ও গভর্নিং বডি ভূয়া ও অবৈধ থাকাকালীন একাডেমি’র সহকারী শিক্ষক মো. বাবুল হোসেন ২০১৯ সালের আগস্ট মাসে উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবর একটি লিখিত অভিযোগ দেন। এ বিষয়ের তদন্তে এর সত্যতা প্রমাণিত হয়। এছাড়া বিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ড বিধি অনুযায়ী সমাজসেবা অধিদপ্তর কর্তৃক অনুমোদিত নয়। এর নেই কোন রেজিষ্ট্রেশন নম্বর, ট্রাস্টিবোর্ডের বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদনে আল ইসলাম ট্রাস্টের বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ। ফলে ওই গভর্নিং বডি অবৈধ বলে গণ্য হয়। ভুয়া ও অবৈধ গভর্নিং বডি কর্তৃক গঠিত অবৈধ নিয়োগ কমিটি বিধি লঙ্ঘন করে মো. হাকিমুল কবির কে অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ দিয়েছিলেন ২০১৯ সালে। তৎকালীন গভর্নিং বডির সভাপতি সাবেক বেড়া পৌর মেয়র আলহাজ্ব আব্দুল বাতেন ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যই ছিলেন না।
তৎকালীন গভর্নিং বডির সভাপতি জামায়াত নেতা এ. কে. এম রফিকুন্নবী ১৪ জুলাই ২০১৯ সালে গভর্নিং বডির সভাপতি পদ থেকে পদত্যাগ করেন এবং ট্রাস্টি বোর্ডের বিধিমতে ট্রাস্টি বোর্ডের সেক্রেটারী ও একাডেমির সাবেক অধ্যক্ষ মোকছুদ আলম চৌধুরীকে গভর্নিং বডির সভাপতি হিসেবে মনোনয়ন দেন। কিন্তু ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হাকিমুল কবির নিজে একাডেমির অধ্যক্ষ হওয়ার জন্য মেয়র আব্দুল বাতেনের সাথে যোগ সাজশ করে অবৈধভাবে গভর্নিং বডির সভাপতির মনোনয়ন দেন।
আব্দুল বাতেন সভাপতি হওয়ার পর হাকিমুল কবির অধ্যক্ষ নিয়োগের জন্য বিজ্ঞাপন দেন এবং সহকারী প্রধান শিক্ষক আব্দুস সবুরকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ দেন। হাকিমুল কবীরের পছন্দের গভর্নিং বডি নিয়োগ কমিটি বিধি লঙ্ঘন করে পরীক্ষার নামে জালিয়াতি করে অধ্যক্ষ নিয়োগ দেন বলে অভিযোগে জানা যায়। আব্দুস সবুর স্কুল শাখার সহকারী প্রধান শিক্ষক হলেও তাকে কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব দিয়ে তার অধীনে নিয়োগ দেয়া নিয়েও বিতর্ক ওঠে।
শিক্ষকদের লিখিত অভিযোগ থেকে আরও জানা যায়, একাডেমিক পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থী ভর্তির নিয়ম থাকলেও বর্তমান অধ্যক্ষ হাকিমুল কবির স্বেচ্ছাচারিতা, স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি করে টাকার বিনিময়ে শিক্ষার্থী ভর্তি করে থাকেন। এমনকি কোন রকম নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও পরীক্ষা ছাড়াই অধ্যক্ষর মামাতো বোন মাছুমা খন্দকারকে মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে ইংরেজি শিক্ষক হিসেবে চাকুরী দিয়েছেন। এসবের প্রতিবাদ করায়, সহকারী শিক্ষক বাবুল হোসেন, নাজিম উদ্দীন, মারুফা জাহান সহ বেশ কয়েকজনকে প্রকার কারণ দর্শানোর চিঠি না দিয়েই হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর, ক্লাস ও মাসিক বেতন বন্ধ করে দেয়া হয়। এ ব্যাপারে ভুক্তভুগী শিক্ষকগণ জেলা প্রশাসক, মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার, উপজেলা নির্বাহী অফিসার, উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারসহ বিভিন্ন দপ্তর বরাবর লিখিত অভিযোগ দিলেও কোন প্রতিকার পাননি বলে ভুক্তভুগী শিক্ষকরা জানান। এ বছরের ফ্রেরুয়ারি মাস থেকে মো. জাহাঙ্গীর আলমের প্রতি অধ্যক্ষ তার হিংসাত্মক মনোভাব দেখিয়ে প্রতিষ্ঠানের পাঠদান, হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর ও বেতন বন্ধ করে দিয়েছেন ।
সহকারী শিক্ষক বাবুল হোসেন জানান, আমি ওই প্রতিষ্ঠানের নানা অনিয়ম দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিভিন্ন দপ্তরে কয়েকবার লিখিত অভিযোগ দিয়েছি। এসব অনিয়ম দুর্নীতির বিরুদ্ধে তদন্তে সত্যতা প্রমাণিত হলেও আজ অবধি কোন আলোর মুখ দেখিনি। একাডেমি ফান্ডের লক্ষ লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করে প্রভাবশালী প্রশাসনকে ম্যানেজ করে সকল অপকর্ম এখনও চালিয়ে যাচ্ছেন বলে তিনি জানান। বেতন ও পাঠদান থেকে বঞ্চিত হওয়া শিক্ষক নাজিম উদ্দীন জানান, আমাকে অহেতুক কোন কারণ দর্শনের নোটিস ছাড়াই আমার পাঠদান ও বেতন বন্ধ করে দেওয়া হয়। আমি বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দিয়ে কোন ফল পাই না। পরে আমি বাধ্য হয়ে প্রতিষ্ঠান সাবেক অধ্যক্ষ ও গভর্নিং বডির বিরুদ্ধে জেলা জজ আদালতে একটি মামলা দায়ের করি। মামলাটি এখনও চলমান রয়েছে। আমার মত আরও অনেক শিক্ষক অনিয়ম দুর্নীতির প্রতিবাদ ও ন্যায্য দাবী করায় আমাদের সবারই এই দশা। একাডেমির বাইরে বেকার হয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে আমরা মানবেতর জীবন যাপন করছি।
অভিযুক্ত অধ্যক্ষ হাকিমুল কবীর বলেন, আলহেরা একাডেমি একটি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান। এখানে শতাধিক শিক্ষক আছেন। তারা সরকারের নীতিমালা অনুযায়ী এমপিও ভুক্ত হয়ে বেতন ভাতা পাচ্ছেন। অভিযোগকারী শিক্ষকরা প্রতিষ্ঠানের নন বেনিফিডেট শাখায় চাকুরী করতেন। অনিয়ম দূর্নীতির কারণে গভর্নিং বডি তাদের বরখাস্থ করেছে। এখানে আইনের কোন ব্যত্যয় হয়নি।
তিনি আরো বলেন, আমার নিয়োগ প্রক্রিয়ার বিষয়ে গভর্নিং বডি বলতে পারবে, আমি পরীক্ষা দিয়ে যোগ্যতা প্রমাণ করে নিয়োগ পেয়েছি। অনৈতিক সুবিধা আদায় করতে না পেরে কতিপয় শিক্ষক মিথ্যাচার করছেন।
বর্তমান গভর্নিং বডির সভাপতি জামায়াতের কেন্দীয় নেতা এ. কে. এম রফিকুন্নবীর সাথে মুঠোফোনে প্রতিষ্ঠানের নানা অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার প্রতিষ্ঠানে কোন অনিয়ম দুর্নীতি হয় না। জমির রেজিস্ট্রেশন অন্যান্য ট্রাস্টভুক্ত প্রতিষ্ঠান যেভাবে করে তাই করা হয়েছে। সঠিক নিয়মেই নীতিমালা অনুযায়ী প্রতিষ্ঠান চলছে। ### ছবিসহ