“ধ্বংস করো এই কচুরিপানা/ এরা লতা নয়, পরদেশি অসুরছানা / ইহাদের সবংশে করো করো নাশ/ এদের দগ্ধ করে করো ছাই পাঁশ/ এরা জীবনের দুশমন, গলার ফাঁস/ এরা দৈত্যের দাঁত, রাক্ষসের ডানা/ ধ্বংস করো এই কচুরিপানা।”
একসময় দেশে কচুরিপানা এতই ভয়ঙ্কর অবস্থা ধারন করেছিল যে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম রীতিমত কচুরিপানা বিরোধী গান লিখেছিলেন যা কবির ‘শেষ সওগাত’ নামের কাব্যগ্রন্থে সংকলিত করা হয়েছে। জ্যাতিমিক হারে রাতারাতি বংশবৃদ্ধি করা কচুরিপানা নিধনে আইন পর্যন্ত পাশ করাও ইতিহাসও রয়েছে দেশে। কিন্তু তিরস্কার দেয়া সেই ফেলনা কচুরিপানাই এখন জোগান দিচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা। বছরে কোটি টাকা আয় আসছে কচুরিপানা থেকে তৈরী হস্তশিল্প রপ্তানিতে।
হস্তশিল্পের নজরকাড়া বিভিন্ন রকম পণ্য তৈরী হচ্ছে পাবনার নিভৃত এক গ্রামে। কচুরিপানায় তৈরী পণ্য পরিবেশবান্ধব হওয়ায় এর চাহিদা দেশের চেয়ে বিদেশের বাজারেই বেশি। ইউরোপ, আমেরিকার অন্তত আটটি দেশে রপ্তানী হচ্ছে এসব পণ্য। যার মাধ্যমে দেড় থেকে দুই কোটি টাকা আয় হয় এক বছরে। পাশাপাশি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কচুরিপানা ঘিরে পাবনার শুধু সাঁথিয়া উপজেলাতেই ১৫টি গ্রামের অন্তত ৩০০ পরিবাররের কর্মসংস্খানের ব্যবস্থা হয়েছে।
সাঁথিয়া উপজেলার ক্ষেতুপাড়া ইউনিয়নের রসুলপুর গ্রামের জয়তুন খাতুন গড়ে তুলেছেন এমনই এক কুটিরশিল্প। এই কাজে তার সহযোগী স্বামী রফিকুল ইসলাম। ৬০ থেকে ৭০ জন শ্রমিক কাজ করছেন সেখানে যার বেশিরভাগই নারী। কচুরিপানা থেকে তারা তৈরী করছেন থেকে টব, ফুলদানি, বালতি, পাটি, ট্রে, ফলঝুড়ি, ডিম রাখার পাত্র, পাপোশ, মোড়া, টুপি, আয়নার ফ্রেম, ডাইনিং টেবিলের ম্যাটসহ ২০ ধরনের পণ্য।
বিভিন্ন আকারের ফুলের টব তৈরিতে ৪০ থেকে ১০০ টাকা মজুরি পান এখানে কর্মজীবিরা। একইভাবে ফলঝুড়িতে ১০০ থেকে ২৫০, পাপোশে ৩০, ফুলদানি ও ট্রেতে ৩৫ থেকে ৭০ ও আয়নার ফ্রেম বাবদ ৪০০ থেকে ৪২০ টাকা মজুরি পান। কেউবা কারখানায় বসে, আবার কেউ বাড়িতে বসে কাজ করে সেগুলো কারখানায় জমা দেন। সংসারের কাজের অবসরে কাজ করতে পারেন নারীরা। কচুরিপানা সংগ্রহ, পরিবহণ ও শুকানোর কাজ থেকেও শ্রমিকরা গড়ে দিনে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা আয় করতে পারেন।
সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, গ্রামীন সরু সড়কের পাশে কুঠির শিল্পটির অবস্থান। কাঁচা কচুরিপানা সেখানে শুকানোর কাজে ব্যস্ত রফিকুল ইসলাম। ভ্যান ভরে সেখানে কচুরিপানা বিক্রি করতে আসেন শ্রমীকরা। উপজেলার ঘুঘুদহ, গৌরীগ্রাম, দোপমাজগ্রাম, ধাতালপুর, ক্ষেতুপাড়া, মিয়াপুর, বহলবাড়িয়া, বানিয়াবছ, গাঙ্গোহাটি এবং পার্শ্ববর্তী বেড়া উপজেলার জগন্নাথপুর, হাটুরিয়া, নাকালিয়াসহ ১৫টি গ্রামের মানুষ প্রতিদিন কচুরিপানা বিক্রি করতে আসেন সেখানে। দিনে গড়ে ৫০ থেকে ৬০ মণ কাঁচা এবং ৫-৭ মণ শুকনো কচুরিপানা ক্রয়-বিক্রয় হয়। প্রতি মণ কাঁচা কচুরিপানা ১০০ থেকে ১২০ টাকা এবং শুকনো বিক্রি হয় ১ হাজার থেকে ১৮০০ টাকায়।
গ্রামের নারীদের মাধ্যমে কচুরিপানা দিয়ে পণ্য উৎপাদনের পাশাপাশি হস্তশিল্প রপ্তানীকারক প্রতিষ্ঠান ‘বিডি ক্রিয়েশনে’ এগুলো বিক্রি করেন। খুলনার একটি কারখানাতেও তিনি পণ্য ও কচুরিপানা সরবরাহ করেন। সেখানে কচুরিপানা থেকে কাগজ, কাগজের পুতুল, নোটবুক, ওয়ানটাইম গ্লাস-প্লেটসহ বাহারি পণ্য তৈরি হচ্ছে।
কিভাবে শুরু হলো জানতে চাইলে জয়তুন খাতুন প্রথমআলোকে বলেন, বিয়ে হয়ে স্বামীর বাড়িতে আসার পর দেখেছি আমার শশুড় বেতের ব্যবসা করতেন। সেটা দেখে আমার স্বামীও ব্যবসা শুরু করেন। এরপর তিন বছর আগে মাথায় আসে বেতের জিনিসপত্র এত দাম দিয়ে যারা কেনে, তারা কিভাবে কি করে, কেন কেনে, সেটা দেখা দরকার। আমার স্বামীর সাথে ঢাকায় যাই বিডি ক্রিয়েশনে। সেখানে গিয়ে দেখতে ও জানতে পারি কচুরীপানা দিয়ে নানারকম পণ্য তৈরী করছে। তখন আমাদের মাথায় আসে আমরাও এটা করতে পারি। তখন বিডি ক্রিয়েশনকে বলি আমাদের শিখিয়ে দেন আমরাও এটা করবো। তারপর সেখান থেকে তিনজন মাস্টার আমাদের গ্রামে এসে হাতেকলমে শিখিয়ে দেন। এভাবেই শুরু করি। তারপর গ্রামের নারীদের এ কাজে আমরা সম্পৃক্ত করি। বর্তমানে ৩০-৪০ জন নারী কচুরীপানা দিয়ে হস্তশিল্পের পণ্য তৈরীর কাজ করছে। বর্তমানে ১০ রকমের পণ্য তৈরী করে বিক্রি করছি। খরচ বাদে প্রতি মাসে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা আয় হয়।
তিনি বলেন, আমার ভবিষ্যত পরিকল্পনা এটিকে আমরা অনেকদূর এগিয়ে নিতে চাই। আরও বড় পরিসরে করতে চাই। কিন্তুআর্থিক সংকটে এগুতে পারছি না। এনজিও থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে লাভ বেশি হচ্ছে না। সরকার যদি অল্প সুদে আমাদের ঋণ দেয় তাহলে আমি এই কাজে গ্রামের অন্তত ২ হাজার নারীকে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারবো।
রফিকুল ইসলাম বলেন, বেতের ব্যবসা থেকে কচুরীপানা দিয়ে হস্তশিল্পের পণ্য তৈরীর ধারণা নিয়ে মাথায় আসে। বিডি ক্রিয়েশন আমাদের সহযোগিতা করছে। কিন্তু অর্থাভাবে বড় পরিসরে করতে পারছি না। কারণ কোম্পানী থেকে অর্ডার নিয়ে এসে নিজেকে অর্থ লগ্নি করে কাজগুলো তুলতে হয়। সেক্ষেত্রে এনজিও থেকে যে ঋণ নেই সেটার অনেক সুদ বহন করতে হয়। লাভ খুব একটা থাকে না। তাই সরকার যদি আমাদের পাশে দাঁড়ায় তাহলে এলাকার অনেক মানুষের কাজের ব্যবস্থা হবে।
এদিকে, কুচরিপানা বিক্রি ও পণ্য তৈরীর কাজ করে অনেকেই সংসারে স্বচ্ছলতা এনেছেন। স্কুল-কলেজ পড়ুয়া অনেক ছাত্রীও এ কাজ করে নিজেদের হাতখরচ ও পড়াশোনার খরচ চালিয়ে নিতে পারছেন। সাঁথিয়ার ধাতালপুর গ্রামের ইন্তাজ আলী, মিয়াপুর গ্রামের নাজমুল মিয়া ও বানিয়াবছ গ্রামের মজিবুর রহমান জানান, প্রতিদিন ৮০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকার কচুরিপানা বিক্রি করেন তাঁরা।
হস্তশিল্প শ্রমিক সরকারি এডওয়ার্ড কলেজের ছাত্রী খুশি খাতুন ও মিয়াপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রী সুমাইয়া খাতুন বলেন, পড়াশোনার ফাঁকে যতটুকু সময় পাই, কচুরীপানার পণ্য তৈরীর কাজ করি। এতে যে আয় হয় তা দিয়ে নিজেদের লেখাপাড়া ও হাতখরচ, পোশাকের খরচ চালিয়ে নিতে পারছি।
রসুলপুর গ্রামের মাজিয়া খাতুন, আকলিমা বেগম, গঙ্গারামপুর গ্রামের ডলি খাতুন, জানান, সংসারের কাজ শেষ করে আমরা এই কাজ করি। এতে সপ্তাহে ১২শ’ টাকা থেকে ১৫শ’ টাকা আয় করতে পারি। তাতে স্বামীর অভাবী সংসারে বেশ কাজে লাগে। আগের থেকে বর্তমানে কিছুটা স্বচ্ছলতা এসেছে।
সাঁথিয়া উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন জানান, আমাদের পক্ষ থেকে ঋণদানের সুবিধা আছে। যদি জয়তুন খাতুন-রফিকুল দম্পতি আমাদের কাছে আবেদন করেন তাহলে আমরা তাদের শতকরা আড়াই ভাগ সার্ভিস চার্জে ঋণ দিতে পারবো। সেইসাথে এই কুটিরশিল্পকে ঘিরে একটি প্রকল্প প্রস্তাবনা দেবার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। যাতে গ্রামের আরও বেশি নারীকে এই কাজে সম্পৃক্ত করা যায়।
বিডি ক্রিয়েশনের জৈষ্ঠ ব্যবস্থাপক (অপারেশন) মাহবুব আলম বলেন, ২০২০ সাল থেকে আমরা কচুরিপানা দিয়ে হস্তশিল্প পণ্য তৈরীর কাজ শুরু করি। ওই বছরের শেষের দিকে সাঁথিয়া জয়তুন-রফিকুল দম্পতি আমাদের সাথে কাজ করছে। আমরা তাদের পাশে থাকতে পেরে গর্বিত।
বিডি ক্রিয়েশনের কর্ণধার আব্দুর রহমান আশিক জানান, শুকনো কচুরিপানা কিনে প্রক্রিয়াজাতের মাধ্যমে তাঁরা বাহারি সব পণ্য তৈরি করেন। আটটি দেশে কচুরিপানার তৈরি পণ্য রপ্তানি হচ্ছে। আরও কয়েকটি দেশের সঙ্গে আলোচনা চলছে। প্রতি বছর দেড় থেকে দুই কোটি টাকার এসব পরিবেশবান্ধব পণ্য রপ্তানি করা হচ্ছে।