‘রোম যখন পুড়ছিল, নিরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছিলেন’ এটি একটি বাংলা প্রবাদ, যা ইংরেজি প্রবাদ- ‘Nero fiddles while Rome burns’ এর অনুবাদ। সেখানে মূলত বাঁশি নয়, বেহালার ধরনের কোনো যন্ত্রের কথা বলা হয়েছিল।
৬৪ খ্রিস্টাব্দে ঘটে যাওয়া রোমের সেই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড আর নিরোর বাঁশি বাজানো নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে আজও বিতর্কের শেষ নেই। ফলে রোমান সাম্রাজ্যের অধিপতিদের মধ্যে অন্যতম সম্রাট নিরো, রোম ধ্বংস হয়ে যাওয়ার সময় বাঁশি বাজানোর মত (নির্লিপ্ত অর্থে) কুখ্যাত কাজ করেছিলেন কিনা তা প্রমাণ করা কঠিন। তবে যুগে যুগে নতুন রুপে যে নিরোদের দেখা মেলে তা স্বীকার করতেই হবে। শুধু আগুনে পোড়া নয়, বন্যার পানিতে ডুবে মরার সময়ও দেখা যায় নিরোদের কিংবা নিরোর দালালদের।
আকস্মিক বন্যায় ডুবে দেশের কয়েক জেলার মানুষ যখন মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচার জন্য প্রানপণ চেষ্টা করছে, তখন পাবনার ঈশ্বরদীর স্বপ্নদ্বীপ রিসোর্টে বর্ণাঢ্য আয়োজনে পালিত হচ্ছে রাশিয়ান জাতীয় পতাকা দিবস উদযাপন। দিনব্যাপী আয়োজনের মধ্যে ছিল শিশুদের চিত্রাঙ্কন, আলোচনা সভা, রাশিয়ান সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য নিয়ে কুইজ প্রতিযোগীতা, পুরষ্কার বিতরণ ও মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
বৃহস্পতিবার (২২ আগস্ট) পাবনার ঈশ্বরদীতে স্বপ্নদ্বীপ রিসোর্টে ডিগো ইন্টারন্যাশনালের উদ্যোগে এই বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করে রাশিয়ার পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটির অ্যালামনাই অ্যান্ড ফ্রেন্ডশিপ অ্যাসোসিয়েশন।
দুপুরে বাংলাদেশ ও রাশিয়ার ছোট ছোট পতাকা হাতে নিয়ে অতিথিদের স্বাগত জানাতে দীর্ঘ সময় ধরে অপেক্ষা করিয়ে রাখা হয় বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষার্থীদের। একসময় অতিথিরা রাশিয়া ও বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা নিয়ে অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত হন। এ সময় বাংলাদেশ ও রাশিয়ার জাতীয় পতাকাকে সম্মান প্রদর্শণ ও দুইদেশের জাতীয় সংগীত পরিবেশন করা হয়।
পরে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন, ঢাকাস্থ রাশিয়ান হাউজের পরিচালক পাভেল দভয়চেনকভ। বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন, ঢাকাস্থ রুশ দূতাবাসের সাবেক কাউন্সিলর আন্দ্রে স্টারকভ, রূপপুর প্রকল্পের রুশ কর্মকর্তা রুবেলা ইউলিয়ানা, পাবনা-৪ আসনের সাবেক সাংসদ সিরাজুল ইসলাম সরদার, ইউল্যাব বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. রমিত আজাদ, খাইরুল গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের পরিচালক আলহাজ্ব খায়রুল ইসলাম, ঈশ্বরদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. শফিকুল ইসলাম শামীম, আয়োজনের প্রধান সমন্বয়ক পাকশী বিপিএড কলেজের অধ্যক্ষ আখতার আনজাম হোসেন ডন। এছাড়াও অনুষ্ঠানে জাতির বিবেক হিসেবে পরিচিত পাবনা ও ঈশ্বরদীর গুনী সাংবাদিকবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
সভার সভাপতিত্ব করেন রাশিয়ার পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটির অ্যালামনাই অ্যান্ড ফ্রেন্ডস অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান সিআইপি প্রকৌশলী আলমগীর জলিল। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন ড্যাফোডিলস্ ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক ড. জামিল খান।
এর আগে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হয় রাশিয়ান জাতীয় পতাকা অংকন এবং রাশিয়ান সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য নিয়ে কুইজ প্রতিযোগিতা। পরে বিজয়ীদের মাঝে পুরস্কারও বিতরণ করা হয়। সবশেষে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নেচে গেয়ে মাতিয়ে তোলেন আমন্ত্রিত অতিথি শিল্পীবৃন্দ।
অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান সিআইপি প্রকৌশলী আলমগীর জলিল বলেন, ‘এই আয়োজন হলো দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ন সম্পর্ক আরো সুদৃঢ় করা। তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানো। রাশিয়ান শিক্ষা, সংস্কৃতি সহ অন্যান্য বিষয়ের সাথে বাংলাদেশের সংযোগ স্থাপন করা হচ্ছে। রাশিয়া সবসময় বাংলাদেশের পাশে আছে। আমরাও তাদের পাশে থাকতে চাই।’
কিন্তু বন্যাকবলিত দেশের বর্তমান অবস্থায় রাশিয়ার পতাকা দিবস পালনের মত এমন আয়োজনের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন নেটিজেনরা। সামাজিক মাধ্যমে সবুজ মোল্লা নামের একজন লিখেছেন- “দেশ যখন ডুবে যাচ্ছে ঠিক সেই মুহুর্তে ঈশ্বরদীর স্বপ্নদ্বীপ রিসোর্টে দেশী বিদেশী নারীদের নাচিয়ে তা উপভোগের আয়োজন করেছেন হাজী সাহেব।”
তার সাথে যোগাযোগ করলে তিনি আরো জানান, স্বপ্নদ্বীপ রিসোর্টের মালিক মুলত একজন জাত ব্যবসায়ী। যখন নুরুজ্জামান বিশ্বাস এমপি ছিলেন তাকে মাথায় তুলে নাচতেন, এরপর মাথায় তুললেন এমপি গালিবুর রহমান কে। সরকার পতনের পর হঠাৎ পাবনা-৪ আসনের (৯১ সালের) সাবেক সাংসদ সিরাজুল ইসলাম সরদারকে মাথায় তুলেছেন এখন। তিনি মুলত তার রিসোর্ট ব্যবসার আড়ালে অবৈধ কর্মকান্ড চালাতেই সবাইকে হাতে রাখেন এসব করে।
এই বিষয়ে কথা হয় পাবনা প্রেসক্লাবের সভাপতি এবিএম ফজলুর রহমানেরর সাথে। তিনি বলেন, আকস্মিক বন্যায় দেশের এই পরিস্থিতে এমন নাচ-গানের অনুষ্ঠান আয়োজন সত্যিই লজ্জাজনক। নুন্যতম বিবেকবোধ থাকলেও এই সময়ে কেউ এমন আয়োজন করতে পারতো না। তারপর আবার রাশিয়ার পতাকা দিবস পালনের জন্য আমাদের বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষার্থীদের অপেক্ষায় দাড়িয়ে রাখার বিষয়টিও মোটেও যুক্তিযুক্ত নয়।
তবে নিরো বা নিরোর দালালরা যতবড় কর্মকান্ডই করুক না কেনো, আসল নিরো দুর থেকে এসব দেখে মুচকি হাসতেই পারে যা বলাই বাহুল্য।